হুমায়ুন শফিক


থুথু
**
একটি দারুণ রকমের বদ-অভ্যাস আছে, যেই জন্য সবার সামনে যেতে বিব্রতবোধ করি; কিন্তু সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য ভিড়ের মধ্যে যেতেই হয় সেদিনও গিয়েছিলাম, কিন্তু লোকটা পাঁচ মিনিটের ভিতর অতিরিক্ত পরিমাণে বোধ করি বিরক্ত হয়েছিল পরে মনে হল, লোকটার ধৈর্য কম এইরকম লোকের জীবনে উন্নতি হবে বলে মনে হয় না
সকাল নয়টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে, ঠিক দশ মিনিটের মাথায় তার নিকট পৌছাই লোকটার নাম, রশিদ হায়দার একজন বিখ্যাত পরিচালক তার পরিচালিত একটি সিনেমা দেখেছিলাম, নাম ভুলে গেছি, কাহিনীটা কিছুটা এমন ছিল যে, নায়িকা নায়ককে চুমু খাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে বমি করবে পরবর্তীতে জানা যাবে চুমু খাওয়ার পর থেকেই নায়িকা প্রেগনেন্ট আজব এক কাহিনী বিশ্বাস করার মত না হলেও বিশ্বাস করেছিলাম, কারণ যিশু যদি মেরির পেট থেকে কোন পুরুষ সঙ্গ ছাড়া জন্ম নিতে পারে, তাহলে একজন পুরুষের চুমু খাওয়ায় একজন নারীর পেটে সন্তান আসা অস্বাভাবিক না
পরিচালক একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন নিজের এলাকায়, তাই চায়ের দোকানেই বসতে বললেন সবাই তাকে চিনতে পারলেও সামনে আসার সাহস করে না দূর থেকে দেখেই চলে যায়, দুই একজন এসে অবশ্য সেলফি তোলে একটি সাদা লুঙ্গি লাল রঙ্গের টি-শার্ট পরে বসে আছেন সময়ের ব্যাপারে খুবই সতর্ক জানতাম, তাই ঠিক সময়ে পৌছাই আমার বাসাও কাছেই তার এখানে একজন প্রোডাকশন ম্যানেজার প্রয়োজন সেইজন্যই মূলত যাওয়া
স্লালামুলাইকুম, স্যার বলতে বলতে মুখে একগাদা থুথু জমে যাওয়ায় বিব্রত হলাম, তার সামনেই কুলি করার মত ফেলে দিয়ে বসলাম সে প্রথম দিকে হয়ত খেয়াল করে নি, বিশেষ কিছু বলল না
আরে বসুন বসুন তার সুন্দর দাঁতগুলো বেরিয়ে গেল এখনও তরতাজা শরীর কথাবার্তায় কোন রকম জড়তা নেই
উনি বলার আগেই বসেছিলাম, পরে চায়ের ওর্ডার দিয়ে একটা বেনসন ধরিয়ে কথা আড়ম্ভ করলেন
সিগারেট খান?
না স্যার মিথ্যা বললাম, সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভিতর জলের মত থুথু চলে আসল যে বেঞ্চে বসেছিলাম, তার উল্টো দিকে থুথু ফেলে হাসলাম হাসিটা বোধ করি গাধার মত হয়েছে
আচ্ছা, তাহলে চা খান, সকালে নাস্তা খেয়েছেন তো?
হ্যাঁ আবার একই অবস্থা এবার আর সামলাতে পারলাম না থুথু ফেলতে দেখে ফেলল ভদ্রতার খাতিরে তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল নাস্তা খেয়েছেন কিনা, কিন্তু থুথু ফেলতে ফেলতে ভুলে গেলাম
আপনার এই কাজে অভিজ্ঞতা আছে? কেন জিজ্ঞেস করল কে জানে? কারণ যতদূর জানি আমার যে অভিজ্ঞতা আছে সেটা সে জানে
জ্বি, স্যার এবার আর লুকানোর সময় পেলাম না, থুথু ফেলে দিয়ে মুখ মুছতে লাগলাম সঙ্গে টিস্যু ছিল বলে রেহাই হাত দিয়ে মুছলে সে কি ভাবত কে জানে? তার মুখ দেখে মনে হল বিব্রত
খুব ভাল, কিন্তু কোথাও টিকতে পারেন নি শুনেছি, বলল, সমস্যাটা কি বলা যায়?
স্যার, আমি তো সমস্যা দেখি না মাঝে মাঝে….
মাঝে মাঝে কি?
না, ইয়ে মানে..থুথু ফেলি
থুথু ফেলেন, এইতো ফেললেন ঠিক সময়ে আবার থুথুতে মুখ ভরে গিয়েছিল ফেলতে বাধ্য হলাম
হাসতে হাসতে বললাম, স্যার..এই জন্যেই
থুথু তো সবাই ফেলে, আপনি ফেললে দোষ কি?
সবাই তো আমার মত ফেলে না বলতে বলতে থুথুতে মুখ আবার ভরে গেল, যেন মুখের ভিতরে জোয়ার-ভাটা চলছে
তা ঠিক ডাক্তার দেখান না কেন? বলতে বলতে হাতের সিগারেট ফেলে দিল চা নিয়ে বলল, চা নিন
চা হাতে নিতে নিতে দুইবার থুথু ফেললাম সেই থুথু ফেলা দেখে চায়ের দোকানদার বলে উঠল, এতো দেহি থুথু-বয় হাহাহা তার সারা শরীর হেসে উঠল
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুখ ভরে গেল, এবার চা-সহ থুথু গিলে ফেললাম গলা দিয়ে যেন আবর্জনা ঢুকে গেল ঠিক টেস্টটা বুঝতে পারলাম না পরিচালক তখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে
স্যার, ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিল, কিন্তু কোন কাজ হয় নি, বরং আরো বেড়েছে আবার থুথু গিলে ফেললাম সে একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তার সামনে এত বার থুথু ফেললে অপমানিত-বোধ করতে পারেন
বেড়েছে বলতে, আগে কি কম ছিল ঘড়িতে সময় দেখে নিল
মানে ছোটবেলায় থুথুই বের হত না, পাঁচ বছর বয়সে ঘন্টায় প্রায় দশবার ফেলতাম, এরপর ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থুথু ফেলার সংখ্যা বেড়ে গ্যাছে এখন প্রতি মিনিটে দশবার ফেলতে হয়
তাহলে তো বিষণ সমস্যা আচ্ছা, উঠি, আপনাকে জানান হবে বলেই সে উঠে গেল এমন কি চা-সিগারেটের বিলটা পর্যন্ত দিয়ে গেল না উঠার সময় তার মুখটা কেমন হয়ে গিয়েছিল, ঠিক নিম পাতার রস খেলে যেমন হয় তেমন
এত তাড়াতাড়ি উঠে যাবে ভাবি নি বিল পরিশোধ করে সেখান থেকে উঠতে উঠতে কয়েকবার মুখের জমিয়ে রাখা থুথু ফেলতে ফেলতে হাঁটা শুরু করলাম
সেদিন বাসায় ফিরে কিছুতেই কোন কাজে মন বসাতে পারলাম না শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, কি করা যায়? সামান্য সমস্যার জন্য কেউ চাকরি দিচ্ছে না ভাবতে ভাবতে মুখ ভরে উঠল পাশেই রাখা একটি পানি রাখার জগে থুথু ফেলে আবার শুয়ে পড়লাম ভাবতে ভাবতে আর থুথু ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, ইদানিং থুথু ফেলার পরিমাণ আরো বেড়ে গ্যাছে ক্লান্ত শরীরে আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে?
ঘুম থেকে যখন উঠলাম, দেখি কেউ নেই মেসের সবাই হয়ত চলে গ্যাছে মেসের ছেলেগুলোও এখন কেমন দৃষ্টিতে যেন তাকায় ঠিক সহ্য করতে পারে না শোয়া থেকে উঠতে যাব, দেখি খাট ভিজে গ্যাছে যেন কেউ পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে বা কোন বাচ্চা প্রস্রাব করে ভাসিয়ে দিয়েছে ভালমত লক্ষ্য করে দেখলাম সম্পূর্ণ খাটই ভেজা নামতে গিয়ে দেখি ফ্লোর পানিতে ভেসে যাচ্ছে কেউ নিশ্চয় কল ছেড়েই বের হয়ে গ্যাছে, দ্রুত প্রত্যেকটা বেসিন চেক করলাম বাথরুমে গিয়ে দেখলাম না কেউ কল ছেড়ে যায় নি তাহলে কি মুখের থুথুর জন্যই এমনটা হল সবাই এসে যদি দেখে এই অবস্থা তখন কি করব তাদের তো এই কথা বলাই যাবে না, একদিনও রাখবে না বাসায়
মগ ভর্তি থুথু বেসিনে ফেলে সেই মগ দিয়ে ফ্লোরের সমস্ত থুথু ফেলতে লাগলাম বিশাল একটা বালতিতে বালতি ভরে বাথরুমে ফেলতে শুরু করলাম ঘন্টাখানেক পরিশ্রমে সবটা পরিষ্কার করতে সমর্থ হলাম কিন্তু মুখ থেকে থুথু বের হওয়া তো বন্ধ হচ্ছে না আজতো তো আরো বেড়েছে, ঘুমের মধ্যে আগে কম হত, পাশেই মগ থাকত, কিন্তু মগে তো এখন কুলাবে না কি করব ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা আইডিয়া চলে আসল
সবাইকে বলে পরের মাসে বাসা ছেড়ে দিলাম এই কথা শুনে বাসার সবার চোখ-মুখ চিকচিক করে উঠল হয়ত খুশিতে সেই বাসা ছাড়ার আগেই অন্য একটা বাসস্থান তৈরি করেছিলাম
এবার একটু আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা বলে নেই, তাকে কিভাবে হারালাম? ওর নাম অন্তু দেখতে খুবই সুন্দর রুপকথার পরীদের মতনই যদিও রুপকথার পরীদের এখনও দেখি নি, অবশ্য দেখার দরকার কি, অন্তুর মত গার্লফ্রেন্ড থাকলে গতমাসেই ওর সঙ্গে ব্রেকআপ হল, কারণটা নিশ্চয় ধরতে পেরেছেন একদিন রমনার একটা বেঞ্চেতে বসে আছি সমস্যাটা জানত, ভেবেছিল, কোনদিন ঠিক হয়ে যাবে চিকিৎসা তো কম করাই নি চিকিৎসার উপরেই ছিলাম কিন্তু সেদিন যে এতটা সমস্যা বেড়ে যাবে, কে জানত?
তোমার প্রোবলেমটা দ্রুত ঠিক কর না, জান?
চেষ্টা তো করছি কিন্তু কিছুই হচ্ছে না বলেই থুথু ফেললাম অভ্যস্ত হয়েছিল তাই কিছুই বলল না
বাসায় তো এখন বলতেও পারছি না
আর কয়টাদিন ওয়েট কর, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলতে বলতে যখন থুথু ফেলতে যাব, কলের পানি যেভাবে পড়ে ঠিক সেইভাবে পড়া আড়ম্ভ করল যেখানে বসেছিলাম, তার সামনেই ছোট একটা গর্তের মত ছিল সেদিকে গেলাম পানিতো মুখ থেকে পড়ছেই, একটানা দশমিনিট বের হল গর্তটা ভরে গিয়ে উপচে পড়তে লাগল তখন দেখলাম অন্তু কিছু বলছে না
দেখলে অবস্থা? বলতে বলতে আবার একই অবস্থা এবার ঠিক সামলে উঠতে পারলাম না, অন্তুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম থুথু সরাসরি ওর গায়ের উপর পড়তে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে অন্তু সরে গিয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ত মুহূর্তেই সিন্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ব্রেক-আপ করবে
একান্তে বাসা নেওয়ার পরে আইডিয়াটা কাজে লাগালাম যেহেতু থুথু দেখতে ঠিক পানির মতনই তাই একটা গাজী ট্যাংক কিনে রোজ ট্যাংক ভর্তি করে বিভিন্ন চায়ের দোকানে বা মুদি দোকানে দিতে লাগলাম, নিজে যেতাম না, একজন ভ্যানওলাকে ঠিক করে রাখলাম খুব অল্প দামেই বিক্রি করতে শুরু করলাম সবাই বলল, পানি তো বেশ টেস্টি বাসা থেকে খুব একটা বের হই না, সারাদিনই কাজের উপর থাকি তিন মাসের মাথায় আমার থুথুর ডিমান্ড বেড়ে গেল আরো তিনটা গাজী ট্যাংক আনতে হল ভ্যানওলাও আরো তিনজন ঠিক করলাম তারা অবশ্যই কিছু জানে না, কোথা থেকে এই পানি আসে
ধীরে ধীরে বাজার বাড়তে লাগল আগে দিতাম একটি এড়িয়ায়, এখন কয়েকটি এড়িয়ায় দেই সবাই খুব খুশি পানির দামটা রাখি অন্যদের থেকে কম, তাই এই পানিই চায় যতদূর শুনেছি, ছোট ছোট বোতলে পানি নিয়ে বাসায় খায় অনেকেই ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করেও পান করে
টাকা-পয়সার তখন অভাব গুচে গেল, কাজ খোজারও আর দরকার হল না একদিন পুলিশ এসেছিল, সেও কিছু বুঝল না, যন্ত্র-পানি সবকিছু দেখে বলল, বাহ, আপনি তো পাতাল থেকে পানি তোলেন, খুব ভাল পানি, দেনতে এক গ্লাস
ঘরে ঢুকে মুখ খুলে গ্লাসে পানি ঢাললাম তাকে দিতেই ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল আবার বলল, খুব ভাল তার হাতে তখন দুই হাজার ধরিয়ে দিয়ে বললাম, চা-টা খাবেন
এই সবের দরকার ছিল কি? বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে বিদায় হলেন
প্রায় দশ বছর পরে, নিজের নামে একটি পানির কম্পানি খুলে বসলাম সেখানে মেশিন-পত্রও এনে একাকার অবস্থা লোকজন তো সবাই অবাক এতদিনে অনেক লাভ হয়েছে, বলতে গেলে প্রায় বিনা পুজিতে ব্যবসা করেছি কম্পানি খুলে সারা দেশেই পানির সাপ্লাই শুরু করলাম সারা দেশের মানুষ পানিটা খুব পছন্দ করেছে সবাই এখন এক নামে চিনে, ‘‘ড্রিংকি’’ কম্পানির নাম ড্রিংকের সাথে একটা কি যুক্ত করে নাম দিয়েছি ‘‘ড্রিংকি’’ অর্থ কি দাড়াল সেই চিন্তা করি নি কেউ কোনদিন জিজ্ঞেসও করে নি তবে একটি বিষয় হচ্ছে, এখন আমি নিঃসঙ্গ অন্তুর সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল, ওর হাজবেন্ডও খুব ভাল একটা কাজ করে শুনলাম আমাকে অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করেনি, সে তো জানেই আমার বিশাল ব্যবসা শুধু বলেছিল, তোমার কম্পানির পানি পান করি না কাউকে কিছু বলব না, চিন্তার কিছু নেই

No comments:

Post a Comment