মাও সে তুং


দেবরূপ সরকারের অনুবাদ


মাও সে তুং-এর কবিতা

মাও সম্পর্কে বা অনুবাদ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার অর্থ দেখিনা, যেখানে সংখ্যাটায় আরো অনেক অনুবাদ রয়েছে। একটা ঘটনা বলা যেতে পারে কেবল, বা অন্য অর্থে, বেশ কয়েকবছর আগের ঘটনাটা উল্লেখ করতে ইচ্ছেই করছে। পশ্চিমবাংলায় সবে সবে বামেদের পতন ঘটেছে, তৃণমূল ক্ষমতায়, হঠাৎই কিছু প্রাসঙ্গিক কারণেই জঙ্গলমহল ও মাওবাদ টানা দীর্ঘসময় ধরেই শিরনামে চলে আসে। বিংশ শতকের একটা লোক, তার নির্দেশিত একটা পথ, সেই মাওবাদ, যত্র-তত্রই, সে বামপন্থী হোক বা না-ই হোক, কমিউনিস্ট বা মাওবাদ সম্পর্কে পড়াশোনা থাক বা না থাক, আমাদের মুনাফালোভী চামড়াহীন মিডিয়ার দৌলতে এতোই আলোচিত হতে থাকে যে গত ১০০ বছরে ভারতের খোদ কমিউনিস্টরা মাওইজ্‌ম নিয়ে এতো আলোচনা করেছে কীনা সন্দেহ! তো যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, ক্লাস ইলেভেন, সেই সময়ে, ২০১৪, ক্লাসের সক্কলকে ইন্ডিভিজুয়ালি জিজ্ঞাসা করেছিলাম “মাওবাদী” শব্দের অর্থ কী! মনে আছে, প্রত্যেকে, এবং প্রত্যেকেই যেটা বলেছিল— সন্ত্রাসবাহী, উগ্রপন্থী, টেরোরিস্ট অথবা অসমাজিক। কিছুমানুষের কার্যকরণ একটা সমষ্টির পক্ষে সমস্যাদায়ক হতেই পারে, যদিও সমষ্টি অর্থে যে বৃত্তটা পাই এই লোকগুলোও দ্যাখা যাবে সেটারই জ্যা বা ব্যাস ধরে ঝুলতে, সেটা এখানে প্রতিপাদ্য নয়, বক্তব্য হল, কী অনায়াসে আমরা ভুলে গেলাম যে মাও একজন মানুষের নাম, আর “মাওবাদ” একটা আদর্শ, বিশ্বাস!

তপতি



তপ
গ্রিষ্ম, ১৯৩৩

লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ,
নীল, বেগুনী, আকাশী:
রামধনুর এই রঙগুলোর সাথে
কে নাচছে আকাশে?
বৃষ্টির পর হাওয়া দিচ্ছে, ঢালু রোদ:
নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রতিটা মুহুর্তের সাথে
পাহাড় আর পাহাড়ি রাস্তাগুলো ক্রমশ নীল হয়ে যাচ্ছে
বিগত বছরের হিংস্র যুদ্ধগুলো:
গ্রামের দেওয়ালগুলোয় গুলির চিহ্ন
এই পাহারগুলো এতোই সুসজ্জিত,
আজ আরো বেশী সুন্দর লাগছে


প্রথম “পরিবৃতি” প্রচারণার বিরুদ্ধে
শরৎ, ১৯৩১

ঘোলাটে আকাশের নীচে গোটা জঙ্গল লাল হয়ে আছে
স্বর্গের সৈন্যদের ক্রোধ মেঘ পর্যন্ত উড্ডীন
কুয়াশা ঢেকে রেখেছে লুংকাং, অস্পষ্ট করে রেছে এর হাজার শৃঙ্গ
একই তীব্রতায় চিৎকার করছে সকলেই:
আমাদের ডানা ছেঁটে দিয়েছে চ্যাং হুই-সান!
দুইশত হাজার শক্তিশালী শত্রুরা ফিরে এসেছে কিয়াংসিতে,
আকাশের মাঝখান ঢেকে গ্যাছে হাওয়ায় ভাসমান তরঙ্গায়িত ধোঁয়ায়
লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আর চাষিরা জেগে উঠেছে
একসাথে লড়ার জন্য,
পুচৌ-এর পাদদেশে লাল পতাকাগুলোড় হাঙ্গামার নীচে!


দ্বিতীয় “পরিবৃতি” প্রচারণার বিরুদ্ধে
গ্রীষ্ম, ১৯৩১

সাদা মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়ের ওপরে মেঘের ফ্যানা,
আর এর নীচে যুদ্ধকালীন তৎপরতার গর্জন
শুকনো গাছ আর পচা কাঠগুলো জড়ো হয়েছে এই দাঙ্গাহাঙ্গামায়
একঝাঁক সশস্ত্র সৈন্যের ভিড়,
যেহেতু সেনানায়ক অবতরণ করলেন আকাশ থেকে
গত পনের দিনে আমরা প্রায় চারশো কিলোমিটার পথ হেঁটে
কুয়াশাচ্ছন্ন কান পেড়িয়ে, জলাশয় আর সবুজে ঢাকা ফুকিয়েন পাহাড় পেড়িয়ে,
শত্রুদের পিছু হটতে বাধ্য করেছি
একটা কন্ঠস্বর তীব্র হাহাকারের মতো;
ওঁর “প্রতিপদে একেকটা দুর্গ” কোনো কাজেই আসেনি!


তিনটে ছোট কবিতা
১৯৩৪ — ১৯৩৫

পাহাড়!
সটান বসে থেকে, আমি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছি
চমকে গিয়ে আমি মাথা তুললাম,
আকাশটা আমার থেকে ঠিক তিন ফুট উঁচুতে!

পাহাড়!
যেন বিশাল ঢেউ ক্রমভঙ্গুর সমুদ্রটাকে উথাল পাথাল করছে,
যেন এক হাজার ঘোড়া
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড গরমে সলম্ফে দৌড়ে চলেছে

পাহাড়!
স্বর্গের নীল ভেদ করা তোমার তীরের সুতীক্ষ্ণ ফলা!
আকাশটা ভেঙে পরবে
কিন্তু কেবল তোমার শক্তিকে সহায্য করার জন্য


জনগনের লিবারেশন বাহিনী নানকিং দখল করলো
এপ্রিল, ১৯৪৯

চ্যাংসানের ওপর দিয়ে বিশাল একটা ঝড় বয়ে গ্যালো,
আমাদের পবিত্র শক্তিশালী সৈন্যরা মহানদী অতিক্রম করে ফেলেছে
ওই শহরটা, একটা নতমস্তক বাঘ, একটা কুঁচিত ড্রাগন, যার প্রাচীন গৌরব ব্যক্ত করছে;
বীরত্বপূর্ণ জয়জয়কারে স্বর্গ আর পৃথিবী কেঁপে উঠছে
ক্ষমতা বজায় রাখতে আমাদের অবশ্যই ভগ্নপ্রায় শত্রুদের খোঁজ করতে হবে
কিন্তু মূর্খ সিয়াং ইউ নয়, বিজেতারা অমূলক খ্যাতি চাইছে
প্রকৃতি কী সচেতন, তারুণ্য থেকে সেও ক্রমশ বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছে,
কিন্তু মানুষের এই পৃথিবী পরিবর্তশীল, সমুদ্রগুলো ক্রমশই তুলো ক্ষেত হয়ে যাচ্ছে


প্লেগের দেবতাকে বিদায়
জুলাই ১, ১৯৫৮

এতো এতো সবুজ মাঠ আর নীল পাহাড়, কিন্তু কি কাজের?
এই ক্ষুদ্র জীবানু হুয়াকেও ক্ষমতাহীন করে দিয়েছে!
শতাধিক গ্রাম আগাছায় অবরুদ্ধ হয়ে আছে, মানুষেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গ্যাছে;
হাজার হাজার বাড়ি খাঁ—খাঁ করছে, আত্মারা শোকসঙ্গীত গাইছে
গতিহীন, এই পৃথিবীতে আমি একেকদিনে চল্লিশ হাজার কিলোমিটার হাঁটি,
আকাশের দিকে তাকিয়ে দূর থেকে আমি অসংখ্য ছায়াপথ দেখি
ওই গোয়ালার কি ঘন্টা বাজিয়ে প্লেগের দেবতার কাছে জানতে চাওয়া উচিত,
সময়ের স্রোত বেয়েও এই একই গ্লানি বয়ে আসবে কিনা?

গভীর উইলোর জঙ্গলের ভেতর শরতের বাতাস বইছে,
ইয়াও আর সান উপজাতি মিলিয়ে এই ভূখণ্ডে ষাট কোটি মানুষ থাকে
রক্তিম বৃষ্টি ঝরে পড়ছে আমাদের আকাঙ্ক্ষায়,
আমাদের ইচ্ছায় সবুজ পাহাড়গুলো সেতুতে পরিণত হচ্ছে
স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তৃত পাঁচ শৈলশিরায় পড়ছে উজ্জ্বল কুরুলের ঘা;
পবিত্র হাতিয়ার পৃথিবীটাকে তিনটে নদী দিয়ে বেঁধে রেখেছে
আমরা প্লেগের দেবতাকে জিজ্ঞাসা করি: “আপনি কোথায় আবদ্ধ আছেন?”
কাগজের তরী আর মোমবাতির শিখা আকাশটাকে আলোকিত করে রেখেছে


একটি আলোকচিত্রের অন্তর্লেখ
ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১

দিনের প্রথম আলোয় জ্বলে ওঠা সামরিক-ক্রিয়াক্ষেত্রে
পাঁচ-ফুট রাইফেল উঁচিয়ে থাকা অবস্থায় ওদের কী উজ্জ্বল আর সাহসী দ্যাখাচ্ছে!
চিনের কণ্যাদের একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন আছে,
তারা তাদের সামরিক পোশাক পছন্দ করে, রঙিন রেশম নয়


কমরেড লি চিনের তোলা একটি ছবিতে অন্তর্লেখ
সেপ্টেম্বর ৯, ১৯৬১

দাঁড়িয়ে থাকা বলিষ্ঠ পাইনের কালো ছায়ার ভেতর দিয়ে,
উন্মত্ত মেঘেরা দ্রুত বয়ে যায়, সত্ত্বর ও চুপিচুপি
পরীদের গুহায় প্রকৃতি নিজেকেও অতিক্রম করে গ্যাছে,
বিপজ্জনক চূড়াগুলোয় অনন্ত বৈচিত্র্য নিয়ে সৌন্দর্য বসবাস করে


দুটি পাখি : একটি সংলাপ
বসন্ত, ১৯৬৫

রূপকথার বিশাল পাখি ডানা ঝাপটিয়ে
পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার জুড়ে উড়ে চলেছে,
এবং উদ্দীপিত করছে একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়
পিঠের ওপর নীল আকাশ নিয়ে সে নীচে তাকায়
মানুষের এই পৃথিবী ও তার দেশ ও শহরগুলো দ্যাখার জন্য
আকাশ ছোঁয়া বন্দুকের গুলি,
মাটিতে কামানের ক্ষত
একটা চড়াই নিজের বাসায় ভয়ে কাঠ হয়ে আছে...
একটা একটা নোংরা নরক!
ওহ্‌ আমি উড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে চাই।”
“কোথায়, আমি জানতে পারি?”
চড়াই উত্তর দ্যায়,
“এল্ফল্যান্ডের পাহাড়ে কোনো বিলাসবহুল প্রাসাদে
তুমি কি জানো না, দু’বছর আগে এই বসন্তের
জ্যোৎস্নার নীচে একটা ত্রৈধ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে?
ওখানে খাবারের কোনো অভাব নেই,
গরম আলুর তরকারী,
মাংসের স্যুপ।”
“তোমার এই ফালতু আজগুবি কথা থামাও!
দ্যাখো, পৃথিবীর ছবিটা পালটে যেতে শুরু করেছে।”



2 comments:

  1. মাও ইংরেজিতেই লিখেছিলেন কি? মানে আমি বলতে চাইছিলাম ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনূদিত হলে মূল অনুবাদটি যিনি করেছেন/ যেখান থেকে নেওয়া হয়েছে সে সম্বন্ধে ২-১ কথা বলতে পারতিস। তবে বাংলাতে একটা সহজতা এসেছে, ভালই। আর ফোনটা ধরিস এরপর থেকে। ব্যস্ত হয়ে পরেছিস হয়ত, ফোনেই পাওয়া যায়না তোকে। ব্যাক ও করিস না। দেখা ফেকা তো দূরের কথা

    ReplyDelete
  2. সুন্দর অনুবাদ হয়েছে , শুভকামনা জানাই

    ReplyDelete